![]() |
লাভের গুড় পিপড়েয় খেলে কে কত ভাগ পায় |
( যাদের রক্ত ও ঘামের বিনিময়ে আজকের আধুনিক বিশ্বের এ যান্ত্রিক বিশ্বায়ন সেই যান্ত্রিক বিশ্বায়নের নির্মাতা দুনিয়ার সব শ্রমজীবী মানুষের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা, সম্মান ও লাল সালাম নিবেদন করছি)
জাতিসংঘের একটি গুরুত্বপূর্ণ সহায়কক শাখা হিসেবে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (International Labour Organisation,ILO) প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে শ্রমিকদের অধিকারসমূহ স্বীকৃতি লাভ করেছে খাতা-কলমে। আইএলও কতগুলি নিয়মকানুন প্রতিষ্ঠা করে এবং সকল দেশে শিল্পমালিক ও শ্রমিকদের তা মেনে চলার আহবান জানায় এবং এভাবে শ্রমিক ও মালিকদের অধিকার সংরক্ষণ করে। বাংলাদেশ আইএলও কর্তৃক প্রণীত নীতিমালায় স্বাক্ষরকারী একটি দেশ।কিন্তু যে উদ্দ্যেশ্যে আইএলও প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল সেটা আদৌ বাস্তবায়িত হয়নি, পুঁজিবাদী বুর্জোয়া রাষ্ট্রের রাজনৈতিক বণিকেরা।
বর্তমান বিশ্বের প্রায় সকলদেশের রাষ্ট্র পরিচালনাকারী হচ্ছেনবুর্জোয়া বণিকেরা, তাদের স্বার্থ ও মুনাফা আগে তারপর শ্রমিকদের কথা।
শ্রমিকদের কত বড় কপাল বছরে একবার হলেও একদিনের জন্য হলেও মজদুর মেহনতি শ্রমিক নামক জীবের মানুষ্যর অধিকার প্রতিষ্ঠার দাত কেলিয়ে আশ্বাস দেয়।
১৯১৯ সালে আইএলও প্রতিষ্ঠার পর ২৮ নভেম্বর প্রথম কনভেনশনে ‘আট ঘণ্টা কর্মদিবস’ ঘোষণা করেছিল। কিন্তু সেই ঘোষণার ১০১ বছর পর এবং মে দিবসের ১৩৪ বছর পর বাংলাদেশে প্রায় ৬৬ শতাংশ শ্রমিক ১০ ঘণ্টার বেশি কাজ করে। মজুরি কম বলে ৯৫ শতাংশ গার্মেন্ট শ্রমিক ওভারটাইম করতে চায়। যন্ত্রের শক্তি মানুষের শ্রমকে লাঘব করবে, ফলে অল্প সময়ে বেশি উৎপাদন হবে, এই প্রত্যাশা থাকলেও বাস্তবে শ্রমিকের শ্রমসময় কমছে না। নারীশ্রমিকের শিল্পে আগমন বেড়েছে কিন্তু তাদের মাতৃত্ব, সংসারের কাজ নিয়ে দ্বিগুণ চাপ বহন করতে হচ্ছে। কর্মক্ষেত্রে অতিরিক্ত পরিশ্রম এবং একঘেয়ে সাংসারিক কাজ নিংড়ে নিচ্ছে নারীদের শ্রমশক্তি। দ্রূত হারিয়ে ফেলছে সে তার কাজ করার ক্ষমতা। তাই দেখা যায়, শিল্প-কারখানায় ৪০ বছরের বেশি বয়সী নারী শ্রমিকরা কাজ করতে পারছে না। অন্যদিকে কারখানার উচ্চপদে বা ট্রেড ইউনিয়নের নেতৃত্বে নারী শ্রমিকদের উপস্থিতি নেই বললেই চলে। ওভারটাইম আর যন্ত্র মিলে অল্প শ্রমিক দিয়ে বেশি কাজ করানোর ফলে কর্মক্ষম যুবশক্তির একটি বড় অংশপ্রতি নিয়ত বেকার হচ্ছে।
এমন পরিস্থিতি বিরাজ করছে বিশ্বব্যাপী। এরই মধ্যে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের নির্বাহী প্রধান ক্লাউস শোয়াব ‘চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে’র সূচনা হয়েছে বলে যে ঘোষণা দিয়েছেন, তা এখন আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। মুনাফা ও মজুরির যে বিরোধ, সেই বিরোধে শ্রমিক সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও দুর্বল ও শোষিত। ফলে সারা দুনিয়ায় খাদ্যপণ্য ও ব্যবহারিক পণ্য উৎপাদন সব রেকর্ড ভেঙে ফেললেও তা সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরেই থেকে যাচ্ছে। শ্রমিকের আয়ের বড় অংশই খাদ্য, বাড়িভাড়া, পোশাক ও চিকিৎসায়ব্যয় হয়ে যাওয়ার ফলে শ্রমিকের হাতে সঞ্চয় যেমন থাকছে না, তেমনি দক্ষতা অর্জনের জন্য বাড়তি খরচ করাও শ্রমিকের জন্য সম্ভব হয়ে উঠছে না। তাহলে ডিজিটাল দক্ষতা শ্রমিকরা অর্জন করবে কীভাবে? তথাকথিত ‘চতুর্থ শিল্প বিপ্লব’ কি তাহলে বেকারত্বের ভয়াবহতা নিয়ে আবির্ভূত হচ্ছে? উৎপাদন এবং বেকারত্ব বৃদ্ধির এই দুষ্টচক্র সামাজিক সব শৃঙ্খলাকেই তো তাহলে ভেঙে ফেলবে। উৎপাদন বণ্টন ও ভোগের ক্ষেত্রে ভারসাম্য আনা এবং আগ্রাসী পুঁজিবাদের হাত থেকে সমাজকে রক্ষা করতে হলে ‘৮ ঘণ্টা কর্মদিবস’ ও ন্যায্য মজুরির কোনো বিকল্প নেই।
শ্রমের মর্যাদা ও শ্রমিকের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (International Labour Organisation,ILO) এবং দেশের শ্রম আইন সংবিধান অনুসারে শ্রমিক শ্রেণীর মানুষের ন্যায্য অধিকার সংরক্ষিত আছে। কিন্তু বা¯Íবে বাংলাদেশের শ্রমজীবী মানুষের অধিকার যেন কিতাবে আছে গোয়ালে নেই। বরাবরই এই দেশের দিনমজুর শ্রেণীর মেহনতি মানুষ বঞ্চিত ও শোষিত। শুধু গার্মেন্টস শিল্পে নয় ওয়ার্কসপ বিভিন্ন মিল, ফ্যাক্টরি ও ব্রিকফিল্ড শ্রমিকের পর সবচেয়ে বেশি শোষণের শিকার হয় ঘরের গৃহকর্মীরা। গায়ে কেরোসিন ঢেলে গরম ইস্ত্রির সেকা দিয়ে পিট ঝলসিয়ে দেওয়া ঘটনা অহরহ। শুধু তাই নয় গৃহ কর্মীদের উপর বর্বর নির্যাতনের পাশাপাশি খুন ধর্ষণও করা হচ্ছে। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় যে গৃহকর্মী নির্যাতনে পুরূষের চেয়ে নারীরাই বেশি এগিয়ে। নারী হয়ে নারীর উপর বর্বরতা নষ্ট সমাজের নিদর্শন। ইসলামের দৃষ্টিতে শ্রমজীবী মানুষের মর্যাদা অনেক বেশি। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সেই সব মানুষকেই বেশি ভালবাসেন যারা সৎ এবং মেহনত করে। তাই শ্রমিকের ঘাম শুকাবার আগেই ন্যায্য পাওনা পরিশোধের তাগিদ দিয়েছে ইসলাম। ১৮৮৯ সালের ১৪ জুলাই অনুষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট কংগ্রেসে ১ মে শ্রমিক দিবস হিসেবে ঘোষিত হয় এবং তখন থেকে অনেক দেশে দিনটি শ্রমিক শ্রেণি কর্তৃক উদযাপিত হয়ে আসছে। রাশিয়ায় এবং পরবর্তীকালে আরও কয়েকটি দেশে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত হবার পর মে দিবস এক বিশেষ তাৎপর্য অর্জন করে। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শ্রমিক শ্রেণির প্রাধান্যের কারণে অধিকাংশ সমাজতান্ত্রিক দেশে বেশ গুরূত্ব ও সংকল্প সহকারে মে দিবস পালন করা হয়। কিন্তু সকল সমাজতান্ত্রিক দেশে দিনটি সাধারণ ছুটি হিসেবে পালিত হয় না। অল্প কিছুসংখ্যক অ-সমাজতান্ত্রিক দেশে মে দিবসে সাধারণ ছুটি পালিত হয়, বাংলাদেশ সেদেশগুলির অন্যতম, যদিও এদেশের শ্রমিকদের মাত্র ১৫ শতাংশ শহুরে-শ্রমিক হিসেবে কাজ করে। বর্তমানে এ সংখ্যা কিছুটা বেড়েছে।
শোষণের বিরূদ্ধে শোষিত মানুষের অধিকার আদায়ে ঐতিহাসিক সংগ্রামের এই দিনটিতে হপৃথিবীর সব দেশে যথাযথ মর্যাদার সাথে ঐতিহাসিক মহান মে দিবস পালন করবে কিন্তু এর বা¯Íবায়ন বিষয়ে সু-সম্পষ্ট ও দৃশ্যমান কাজ বলতে শেøাগান-বক্তিতা আর আশ্বাস এটাই দুঃখ ও পরিতাপের বিষয় এ যেন দিবস আছে রজনী নেই, শোষণ বঞ্চনা ও অমানুষিক নির্যাতন যেন শ্রমজীবীর মানুষের পিছু ছাড়ছে না। ১৮৮৬ থেকে ২০২০ সাল কালের ব্যবধান ভিন্ন হলেও এখনও অভিন্ন শ্রমজীবী মানুষের সেই দাবি অপূরণই থেকে গেল। কেবল দিবস আসলেই আমরা শ্রমজীবী মানুষের ন্যায্য অধিকারের কথা বলি কিন্তু বা¯Íবে মজদুর মেহনতি মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে শাসক, প্রশাসক ও মালিকগোষ্ঠি আদৌ আন্তরিক নই। যদিও সময়ের ব্যবধানে শ্রমজীবী মানুষের যান্ত্রিক বিপ্লবের কারণে কাজের পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু পরিবর্তন আসেনি জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা অধরাই থেকে গেল। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, ৮ ঘন্টা কাজের সেই দাবি এখনও দাবির মিছিলে শেøাগান হয়ে আছে আজ ঐতিহাসিক মহান মে দিবস। এ উপলক্ষে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রী, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রী বিশেষ বাণী প্রদান করেন, সেটার বা¯Íবায়ন করেন আর নাই করেন।
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায় -
‘এই পৃথিবীর যা কিছু মহান-
যা কিছু কল্যাণকর
অর্ধেক তার গড়িয়েছে নারী
অর্ধেক তার নর।’
কিন্তু পোষাক শিল্পের বিকাশে নরের চেয়ে এই দেশে নারী শ্রমিকের অবদান অনেক বেশি। কিন্তু দুঃখ ও পরিতাপের বিষয় , যে নারী শ্রমিকের অবদানে দেশের জাতীয় অর্থনীতি সমৃদ্ধ হচ্ছে সেই নারী শ্রমিকের চলমান জীবনযাপন বড়ই দুর্বিষহ। বেতনের সাথে যাদের জীবনযাত্রার ব্যয় খাপ খায় না তারাই হলেন গার্মেন্টস শ্রমিক। যারা দিনের সূর্য উঠার আগে চোখে ঘুম নিয়ে বিছানা ছাড়ে সেই গার্মেন্টস শ্রমিকদের দূর্ভাগ্য যেন পিছু ছাড়ে না। একের পর এক ট্রাজেডি শিকার হচ্ছে দেশের পোষাকশিল্প শ্রমিক। বাংলাদেশের পোষাক শিল্পে শ্রমজীবী মানুষের দুঃসহ স্মৃতির তীব্র যন্ত্রণা রানা প্লাজা ট্রাজেডি। রানা প্লাজা ট্রাজেডিতে নিখোঁজ ১০৫ জন শ্রমিকের সন্ধান দীর্ঘ তিন বছরেও মিলেনি। যে ট্রাজেডিতে ১১৩৫ জন মানুষকে নির্মমভাবে প্রাণ দিতে হয়েছে। ঘটনার ৩ বছর পূর্ণ হলেও অনেকের কপালে ক্ষতিপূরণের অর্থও জোটেনি। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভারের রানা প্লাজা ভবন ধসে পড়ে। ধসে পড়ার আগে ভবনে বড় ধরনের ফাটল দেখা দিলেও ভবন মালিক খামখেয়ালিপনার কারণে এই ট্র্যাজেডি সৃষ্টি হয়েছে বলে প্রমাণিত হয়েছে। ভবন মালিক সোহেল রানার বিরূদ্ধে সারাদেশের মানুষ সোচ্ছার হয়ে উঠেছিল। সহস্রাধিক মানুষের মৃত্যুর জন্য সোহেল রানার বিচারের জন্য দেশবাসী অপেক্ষার প্রহর গুনছে গত ৩ বছর থেকে। কিন্তু দুঃখ ও পরিতাপের বিষয় এই ঘটনার চার্জশীট এখনও দেওয়া হয়নি। শুধু তাই নয়, দীর্ঘ ৩ বছরেও অনেকে ক্ষতিপূরণের অর্থ পায়নি। এই ব্যর্থতার দায় কার? শ্রমিকের ক্ষতি পূরণ পাওয়া করুণা নয়- এট তাদের অধিকার। আমরা কি পেরেছি রানা প্লাজার ক্ষতিগ্র¯Í মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে? এর আগে ২০১২ সালে নভেম্বর মাসে ঢাকার তাজরীন ফ্যাশনে ১১২ জন পোষাক শ্রমিকের মৃত্যু ঘটেছিল। এছাড়া আরো অনেক দুর্ঘটনায় ঢাকা চট্টগ্রামের পোষাক শিল্পের দুঃসহ যন্ত্রণার ইতিহাস হয়ে আছে। বাংলাদেশে কাজের ক্ষেত্রে পোষাক শ্রমিকের পর নির্মাণ শ্রমিকদের কর্মক্ষেত্র অনেক ঝুঁকিপূর্ণ। এসব ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় যাদের রক্ত ও ঘাম মিশে আছে সেই তারা তাদের শ্রমের ন্যায্য পাওনা অনেক সময় পায় না। শ্রম দিয়ে যারা শ্রমের মূল্য পায় না তারাই জানে জীবন সংগ্রামে বেঁচে থাকার লড়াই কত কষ্টের?
মে দিবসের প্রধান দাবি ‘আট ঘণ্টা কর্মদিবস’ ২২ লাখ সরকারি কর্মকর্তা, কর্মচারীর ক্ষেত্রে বা¯Íবায়িত হলেও কোটি-কোটি বেসরকারি শ্রমিক-কর্মচারী এখনো ‘আট ঘণ্টা কর্মদিবস’-এর সুযোগ থেকে বঞ্চিত। বরং শ্রম আইনে কৌশলে ১০ ঘণ্টা কাজের ব্যবস্থা করা হয়েছে। নিম্ন মজুরির ফাঁদে শ্রমজীবী মানুষকে এমনভাবে আটকে ফেলা হয়েছে, শ্রমিকরা এখন বাধ্য হয় ওভারটাইম করতে, তা না হলে তার সংসার চালানো অসম্ভব।
কার্ল মার্ক্স হিসাব করে দেখিয়েছিলেন, মালিকের মুনাফা বাড়ানোর পথ দুটি। শ্রমিকের শ্রম সময় বাড়ানো আর যন্ত্রের ব্যবহার বাড়ানো। ফলে কর্মঘণ্টা বাড়ছে, উৎপাদনও বাড়ছে, সঙ্গে পাল্টা দিয়ে বাড়ছে বেকারত্ব। বিপুলসংখ্যক বেকার শ্রমবাজারে রিজার্ভ আর্মির কাজ করছে বলে কম মজুরিতেই কাজ করানো সম্ভব হচ্ছে।
প্রতি বছর শ্রমের বাজারে কাজ প্রত্যাশী ২০/২২ লাখ তরুণ যুবক আসে, যাদের মাত্র দুই লাখের মতো কর্মসংস্থান রাষ্ট্র করতে পারে। ৭ থেকে ১০ লাখ লোক পাড়ি জমায় বিদেশে কাজ করতে আর বাকিরা দেশে কোনোমতে কাজ খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করে। দেশের ৬ কোটি ৩৪ লাখ শ্রমজীবীর মধ্যে প্রায় তিন কোটি লোক কাজ করে কৃষি খাতে। যেখানে বছরে তিন মাসের বেশি কাজ থাকে না। ফলে বহু ধরনের অপ্রাতিষ্ঠানিক কাজের মাধ্যমে তারা টিকে থাকার চেষ্টা করে। এর বাইরে চার লাখ শ্রমিক গার্মেন্টেস, ৩০ লাখের বেশি লোক নির্মাণ খাতে, ৫০ লাখ লোক পরিবহন খাতে, ১০ লাখের বেশি দোকান কর্মচারী, পাট, চা, চামড়া, তাঁত, রি-রোলিং, মোটর মেকানিক, লবণ, চিংড়ি, সংবাদমাধ্যম, হাসপাতাল-ক্লিনিক, পু¯Íক বাঁধাই, হকার, রিকশা-ভ্যানচালক, ইজিবাইকচালক, সিকিউরিটি গার্ডসহ বিভিন্ন খাতে কাজ করছে। শ্রমশক্তির এক কোটি দুই লাখ লোক প্রাতিষ্ঠানিক খাতে আর বাকিরা অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করে থাকে। মজুরি বোর্ডের মাধ্যমে ৪৩টি সেক্টরের শ্রমজীবীদের নিম্নতম মজুরি নির্ধারণের ব্যবস্থা থাকলেও বাকি কোটি কোটি শ্রমিকই ‘কাজ নাই তো মজুরি নাই’ নীতিতে কাজ করতে বাধ্য হয়ে থাকছে।
কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় তার কবিতার ভাষায় ব্যাক্ত করেছেন এই সকল শ্রমিকের জাগরণের আর্তি,
“প্রিয়, ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য
ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা,
চোখে আর স্বপ্নের নেই নীল মদ্য
কাঠফাটা রোদ সেঁকে চামড়া।
চিমনির মুখে শোনো সাইরেন-শঙ্খ,
গান গায় হাতুড়ি ও কাস্তে
তিল তিল মরণেও জীবন অসংখ্য
জীবনকে চায় ভালবাসতে।
প্রণয়ের যৌতুক দাও প্রতিবন্ধে,
মারণের পণ নখদন্তে;
বন্ধন ঘুচে যাবে জাগবার ছন্দে,
উজ্জ্বল দিন দিনান্তে।
শতাব্দী লাঞ্ছিত আর্তের কান্না
প্রতি নিঃশ্বাসে আনে লজ্জা;
মৃত্যুর ভয়ে ভীরুবসে থাকা, আর না -
পরো পরো যুদ্ধের সজ্জা।
প্রিয়, ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য
এসে গেছে ধ্বংসের বার্তা,
দুর্যোগে পথ হয় হোক দুর্বোধ্য
চিনে নেবে যৌবন-আত্মা।”
শ্রমিকদের সংগঠিত হওয়ার পথে আইনি এবং আইনবহির্ভূত অসংখ্য বাধা রয়েছে। সে কারণে দুই লাখের মতো ছোট-বড় প্রতিষ্ঠান থাকলেও ট্রেড ইউনিয়নের সংখ্যা আট হাজারের কম। দেশের প্রধান রপ্তানি খাত গার্মেন্টে চার হাজারের বেশি কারখানা থাকলেও ট্রেড ইউনিয়ন আছে এমন কারখানা কাগজে কলমে ৬৬১, বাস্তবে ক্রিয়াশীল ট্রেড ইউনিয়নের সংখ্যা আরও অনেক কম। দেশের আটটি ইপিজেডে ট্রেড ইউনিয়ন অধিকারই নেই। আইএলও কনভেনশন ৮৭ ও ৯৮-তে বাংলাদেশ ১৯৭২ সালেই অনুসমর্থন করলেও, শ্রমিকরা স্বাধীনভাবে ট্রেড ইউনিয়ন করার ও পছন্দমতো নেতা নির্বাচনের অধিকার থেকে এখনো বঞ্চিত। ট্রেড ইউনিয়ন হলো শ্রমিকের ঐক্যবদ্ধ ও শিক্ষিত হওয়ার একমাত্র উপায়, যা না হলে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও শ্রমিকরা অসহায়। মালিকদের ক্ষমতা আর শ্রম আইনের দুর্বলতার কারণে শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করা ও টিকিয়ে রাখাকে দুঃসাধ্য করে ফেলা হচ্ছে। এ কারণেই স্বল্প মজুরি আর দীর্ঘ কর্মসময়ের দুষ্টচক্রে বাঁধা পড়ে আছে বাংলাদেশের শ্রমিক। দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়ছে, মাথাপিছু আয় বাড়ছে। মাথাপিছু আয় বর্তমানে ১৯০৯ ডলার। ডলার ৮৪ টাকা ধরলে তা দাঁড়ায় ১ লাখ ৬০ হাজার ৩৫৬ টাকা অর্থাৎ মাসিক আয় দাঁড়ায় ১৩ হাজার ৩৬৩ টাকা। অথচ দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাতের শ্রমিকের সর্বনিম্ন মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছে আট হাজার টাকা। ফলে উৎপাদনের প্রধান চালিকাশক্তি শ্রমিক মাথাপিছু আয়ের তুলনাতেও কম মজুরি পাচ্ছে এবং এই বৈষম্য ক্রমাগত আকাশচুম্বী হচ্ছে। কর্মসময় কমছে না, যন্ত্র কেড়ে নিচ্ছে কাজ।
কার্ল মার্ক্স বেঁচে থাকলে আজ তাঁর বয়স হতো দুশো বছরের বেশী। উনিশ শতকের এই দার্শনিক সমাজ এবং পুঁজিবাদ সম্পর্কে যে বিখ্যাত ভবিষ্যদ্বাণীগুলো করেছিলেন, সেগুলোর প্রায় সবই সঠিক প্রমাণিত হয়েছে?
সমাজ এবং পুঁজিবাদ সম্পর্কে নিজের বিখ্যাত তত্ত্বের জন্য মার্ক্সের খ্যাতি দুনিয়া জোড়া। তার ভবিষ্যদ্বাণীগুলো কি সব সঠিক প্রমাণিত হয়েছ? কয়েকটি পর্যলোচনা করে দেখা যাক।
'কাল্পনিক চাহিদা' তত্ত¡;
কার্ল মার্ক্স বলেছিলেন পুঁজিবাদ এমন সব জিনিস তৈরি করবে, যা মানুষের দরকার নেই, কিন্তু তারপরেও সে বস্তুর চাহিদা তৈরি হবে। একেই তিনি 'কাল্পনিক চাহিদা' বলে নাম দিয়েছিলেন।
যেমন ধরা যাক, ফ্যাশন। চলতি হাওয়ার সাথে তাল মিলিয়ে কাপড়-চোপড় পরতে গিয়ে আমরা এমন সব কাপড়-চোপড় ফেলে দিচ্ছি যেগুলো আসলে এখনো ব্যবহার করা যায় অথবা বর্তমানের স্মার্টফোনের কথাই ধরা যাক। যে স্মার্টফোনটি আপনার হাতে আছে, তার তুলনায় বাজারে আসা নতুনটির তফাৎ খুব সামান্যই। তারপরও ফোন কোম্পানিগুলো বিরামহীন নতুন মডেল উদ্ভাবন করে বাজারে ছাড়ছে এবং সর্বশেষ মডেলের ফোনটির জন্য রীতিমত প্রতিযোগিতা চলছে ভোক্তাদের মধ্যে।
'উত্থান এবং পতন' তত্ত¡;
পুঁজিবাদের প্রকৃতিই হচ্ছে এটি 'অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি' আর 'মন্দা'র মধ্যে ঘুরপাক খায়। সেই অর্থে ২০০৮ সালে বিশ্ব জুড়ে অর্থনৈতিক মন্দা তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী মতই হয়েছে।
তিনি বলেছিলেন, লাভের জন্য পুঁজিবাদের যে তীব্র ক্ষুধা, সেজন্য বিশ্বে মানুষের যা প্রয়োজন তার চেয়ে উৎপাদন অনেক বেশি হবে এবং শ্রমিকের মজুরি এতই কমবে যে তারা নিজেদের উৎপাদন করা পণ্য কিনতে পারবে না।
আর মানুষ পণ্য না কিনলে পুঁজিবাদীরা মুনাফা করবে কিভাবে? যে কারণে পুরো ব্যবস্থা ব্যর্থ হতে শুরু করবে।
'একাধিপত্য'
সাধারণ অর্থে পুঁজিবাদের বাজারে প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করার কথা। যেমন পাড়ার মাংস ও মাছ বিক্রেতার মত ছোট ব্যবসা পরস্পরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করবে।
কিন্তু কার্ল মার্ক্স বলেছেন, কোম্পানিগুলো এত বড় হতে থাকবে যে তারা নিজেদের প্রতিদ্বন্দীদের ক্রমে গ্রাস করে নেবে, যতক্ষণ পর্যন্ত না তাদের একাধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়।
মনে করে দেখুন তো, বড় সুপার মার্কেট চেইন রেখে কে কবে পাড়ার ছোট দোকানটিতে ঢুকেছেন?
'মধ্যবিত্তের সংকোচন'
কার্ল মার্ক্স বলেছেন, পুঁজিবাদের ধরণ অনুযায়ী মুনাফার জন্য বড় ব্যবসায়ীরা কর্মীদের বিশেষ করে সাধারণ শ্রমিকদের বেতন ও সুবিধাদি কমিয়ে দেয়।এতে মধ্যবিত্ত ক্রমে গরীব হতে থাকে। এর ফলে একটি বড় অংকের নগদ অর্থ অল্প কিছু মানুষের হাতে জমতে থাকে।
আজকের পৃথিবীতে তিন শো সত্তুর কোটি মানুষের যা সম্পদ, তার চেয়ে বেশি সম্পদ আছে মাত্র ৪২ জন ধনী মানুষের হাতে। উলেøখ্য যে, চীন, ভারত আর যুক্তরাষ্ট্রের সম্মিলিত জনসংখ্যা তিন শো সত্তুর কোটি।”
শ্রমজীবী মানুষের শোষণ আর বঞ্চনার বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রামের প্রতিবাদ ও বিরোধীতায় জন্ম নেয় মে দিবসের। ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও, লড়াই করো’ যে শ্লোগান, তার প্রেরণাও লুকিয়ে আছে এই শ্রমিক দিবসেই। প্রায় দেড়শ বছর আগে শ্রমিকদের প্রাণের বিনিময়েই অর্জিত হয় দিনে আট ঘণ্টা শ্রমের নিশ্চয়তা। এরপর থেকেই দেশে দেশে উদযাপিত হয়ে আসছে শ্রমিকদের মর্যাদা অর্জনের এই দিনটি। আমাদের দেশেও শ্রমিক সংগঠনগুলো তো বটেই, রাষ্ট্রীয়ভাবেও পালিত হয় শ্রমিক দিবস উপলক্ষে বিভিন্ন কর্মসূচি।কিন্তু যাদের জন্য এই মে দিবসের আয়োজন, সেই শ্রমিকরা কতটুকু জানেন এই দিবসটি সম্পর্কে? মে দিবসের ইতিহাস, দিবসটির তাৎপর্য এর কতটুকু জানেন তারা? অধিকাংশ শ্রমিকদের ধারনা, এই দিবসটি তাদের কাছে একটি ছুটির দিন বৈ অন্য কিছু নয়। বড়জোড় মে দিবসের অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে নিজেদের কিছু দাবি-দাওয়া তুলে ধরার মধ্যেই সীমাবদ্ধ তাদের মে দিবসের কার্যক্রম। আবার কেউ কেউ মে দিবসের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আসেন শ্রমিক নেতার অনুরোধে। কেউ কেউ আবার আসেন কৌতূহল থেকে, কী হয় এই দিনের আয়োজনে। মে দিবস উপলক্ষে মানববন্ধন, সমাবেশ আয়োজন করে বিভিন্ন ধরনের শ্রমিকদের সংগঠন। সেসব অনুষ্ঠানে যোগ দিতে জাতীয় প্রেস ক্লাবসহ সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে জড়ো হন হাজার হাজার শ্রমিক।
শ্রমিকদের মে দিবসে মূল উদ্দেশ্য সম্পর্কে শতকরা নব্বই ভাগের ও বেশী শ্রমিক কিছুই জানেন না। অথচ রাষ্ট্রিয় ভাবে কত সভা, সেমিনার, ¯শ্লোগান মুখরিত সমাবেশে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যকিাতবর্গ, সুশীল সমাজ, তাদের দোসর শ্রমিকনেতা নামধারীরা জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়ে শ্রমিকের নায্য অধিার পূরণের আশ্বাস দিয়ে কেটে পড়েন। হতভাগা শ্রমিকের দল পুঁজিবাদী বুজোঁয়াদের কূটচাল না বুঝেই শ্লোগান মুখর হাততালিতে মেতে ওঠেন। ‘মে দিবস জন্ম কেন, সেই ১৮৮৬ সালের মে দিবসের সঙ্গে আজকের মে দিবসের প্রেক্ষাপটের পার্থক্য কী, মে দিবসের মূল উদ্দেশ্য কী? এগুলো নিয়ে আমাদের শ্রকিদের বোঝানো হয় না। প্রতিবছর রীতি মেনে শ্রমিকেরা একত্রিত হয়। সারাবছরও বিভিন্ন ইস্যুতে শ্রমিকেরা নায্য দাবী করলে শ্রমিকের নেতা নামক প্রতিষ্ঠান মালিকের পা-চাটা সুবিধাভোগদের দিয়ে আন্দোলন পন্ড করার জন্য নানান ফন্দি-ফিকিরে লিপ্ত হয়, পুঁজিবাদী বুজোঁয়া মালিকেরা সরকারের অসাধু মন্ত্রী, আমলাদের সহায়তায় প্রশাসন দিয়ে অসহায় শ্রমিকদের উপর দমন-নিপীড়নের তান্ডব চালায়। সমসাময়িক ইস্যুগুলো নিয়েই আমাদের ব্যাস্ত থাকতে হয় তাই শ্রমিকদের সেই ক্ষুধার্ত-কান্নার রোল আমাদের সুনাগরিকের কানে পৌছালেও নিশ্চুপ থাকি।তাই আজও মে দিবসের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সফলভাবে বা¯Íবায়ন ঘটেনি। সাম্প্রতিক এই করোনা ভাইরাসজনীত মহামারীর সময়ে গার্মেন্টস শ্রমিকদের বকেয়া বেতন তো দেয়নি, পাশাপাশি ইচ্ছেমত মালিকপক্ষের শ্রমিক ছাটাই করছে। মালিকপক্ষের খেয়াল খুশিমত গার্মেন্টস খুলবার ঘোষনা দিয়ে শ্রমিকদের কাজে যোগ দিতে রাতারাতি আহ্বান করছে, সারাদেশের লক-ডাউন উপেক্ষা করে শ্রমিকের খেয়ে-নাখেয়ে পায় হেঠে, গরু-ছাগলের ট্রাকে চড়ে, মহামারীতে সংক্রমণের আশংকা নিয়ে চাকরী বাচনোর দায় কারখানায় এসে দেখছেন বড় তালা ঝুলানো। কারখানার মূল ফটকে বড় করে কারখানা নাখোলার নোটিশ ঝুলানো। যেন শ্রমিকরা মানুষ নয়, ওরা এখনো দাস হয়ে আছে একুশ শতকেও। সারবছর জুড়েই কোন না কোন কারখানায় বকেয়া বেতন এর দাবীতে আন্দোলন চলছেই। যদিও আমাদের দেশে শ্রম আইন ও শ্রম আদালত আছে। কিন্তু তার বা¯Íবায়ন এবং প্রয়োগ যথাযথ আদৌ কি হচ্ছে। পুঁজিবাদী বুজোঁয়া মালিকেরা কি মানছে কি আইন, তারা প্রচলিত আইনের ফাঁকফোর গলে ঠিকই বের হয়ে যাচ্ছে নয় কি? মে দিবসের মূল তাৎপর্য খাতা- কলমে আর দিবস উদযাপনেই সীমাবদ্ধ, ওদিকে না খেয়ে মরুক শ্রমিকের দল। এই কিছুদিন আগে খুলনার পাঠকল শ্রমিকেরা যখন তাদের বকেয়া বেতন-ভাতার দাবীতে আমরণ অনশন করে কয়েকজন শ্রমিক প্রাণ দিচ্ছিলেন তখন বিদেশ থেকে কোটী কোটী টাকা দিয়ে নায়ক-নায়িকা, গায়ক-গয়িকা ভাড়া করে এনে বিপিএল এর জমকালো উদ্বোধন করলেন আমাদের মাননীয় প্রধাণমন্ত্রী। জুলুমের বিরুদ্ধে মজলুমের জয় হবেই একদিন না একদিন। তাই ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও লড়াই কর’ শ্লোগানটি মে দিবসে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। কিন্তু শ্রমিকদের পরিবার নিয়ে দুবেলা দু-মুঠো ভাতের নিশ্চয়তা আজো অর্জিত হয়নি। অথচ এই দেশে সরকারী চাকুরেরা বৈশাখী ভাতা পায় আর শ্রমিক নামক কামলারা বৈশাখী ঝড়ের তান্ডবের মত দারিদ্রতার জন্য ত্রাণ পায়। সে ত্রাণ আবার জনপ্রতিনিধিরা মেরে খায়, চুরি করে।
ফরাসি বিপ্লবের আকাঙ্খা এবং সাম্য প্রতিষ্ঠার চেতনার মধ্যে জন্ম নিয়েছিল মে দিবসের চেতনা। ফরাসি বিপ্লব শুধু সাম্য মৈত্রী স্বাধীনতার শ্লোগান তোলেনি, সঙ্গে সঙ্গে মত প্রকাশের, মত প্রচারের, মত প্রতিষ্ঠার অধিকারের আকাঙ্খারও জন্ম দিয়েছিল। ১৭৮৯ সালের পরের পৃথিবী তাই আর আগের মতো থাকেনি। মর্যাদা আর অধিকার ছাড়া মানুষ বাঁচবে কীভাবে? তবে কি মানুষের জীবন পশুর জীবনের মতোই হয়ে যাবে?
এই প্রশ্নের উত্তর পেতে শ্রমের ভূমিকার কথা শ্রমিকের মর্যাদার কথা ভাবতে হয়েছে। এডাম স্মিথ আর ডেভিড রিকার্ডো দেখালেন মানুষের শ্রমের ফলেই মূল্য তৈরি হয়। মূল্যের শ্রমতত্তে¡র স্বীকার করে নেওয়া হলো শ্রমিকের শ্রমের ভূমিকার কথা, কিন্তু তার বিনিময়ে শ্রমিক কী পাবে, সে প্রশ্নের সমাধান হলো না। গ্রাম থেকে উঠে আসা কারখানা শ্রমিকে পরিণত হওয়া শ্রমিক জীবন বাঁচাতে অক্লান্ত পরিশ্রম করছে কিন্তু তাদের জীবনের ন্যূনতম চাহিদা পূরণ করতে পারছে না। অথচ মালিকদের প্রাচুর্য ও জৌলুশ বাড়ছে। এই বৈষম্য তাদের মধ্যে বিক্ষোভের জন্ম দিতে শুরু করল, যার ফলে কারখানা ভাঙা, ম্যানেজার হত্যার মতো ঘটনা ঘটতে শুরু করল। কিন্তু অভিজ্ঞতা থেকে শ্রমিক শ্রেণি বুঝেছিল, এ পথে তো সমাধান আসবে না। তাই ১৮৭১ সালে প্যারি কমিউন প্রতিষ্ঠা করে রাষ্ট্র গঠনের চেষ্টা করেছিল তারা। কিন্তু বুর্জোয়াদের কূট কৌশলে প্যারি কমিউনের পরাজয়ে শ্রমিক শ্রেণি সাময়িক থমকে দাঁড়ালেও শ্রমিকের সমস্যা যেহেতু সমাধান হয়নি, তাই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বের প্রায় সকল দেশে। এ ধরনের বহু আন্দোলন আর পরাজয়ের বেদনার মধ্য দিয়েই জন্ম নিয়েছিল ‘৮ ঘণ্টা কর্মদিবসের আন্দোলন’।
১৮৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লবের শতবর্ষ উপলক্ষে প্যারিসে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনে ফ্রেডেরিক এঙ্গেলসের উপস্থিতিতে ১‘মে কে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসেবে পালন করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। পরে ১৯১৯ সালে আইএলও প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর সারা বিশ্বে মে দিবস পালিত হয়ে আসছে। মজার ব্যাপার যে দেশে মে দিবস আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল, সেই আমেরিকাতে রাষ্ট্রীয়ভাবে মে দিবস পালিত হয় না। তারপরও পৃথিবীর প্রায় সকল দেশে মে দিবস সরকারি ছুটির দিন হিসেবে আজ স্বীকৃত। আর সারা দুনিয়ার শ্রমজীবী মানুষ গভীর আবেগে মে দিবস পালন করে তাদের শ্রমদাসত্ব থেকে মুক্তির আকাঙ্খা নিয়ে।
‘Labor is the superior of capital, and deserves much the higher considerationÕ
-Abraham LincolnÕ’। বাংলা করলে যার অর্থ দাঁড়ায়, শ্রমই হচ্ছে শ্রেষ্ঠ মূলধন এবং এটিই সর্বোচ্চ বিবেচনার দাবি রাখে।
লড়াইয়ের শুরুটা হয়েছিল ১৮৮৬ সালে পহেলা মে। এই দিন আমেরিকার শিকাগো শহরে হে মার্কেটে। মানবের প্রতি দানবীয় শ্রমঘন্টার বিরুদ্ধে ৮ ঘন্টা কাজের দাবিতে সেই দিন লক্ষ-লক্ষ মানুষ ন্যায্য অধিকার আদায়ে সমবেত হয়েছিল শিকাগোর হে মার্কেটে। ১লা মে’র শিকাগো ধর্মঘট শেষ পর্যন্ত রক্ত সংগ্রামে পরিণত হয়। পহেলা মে ধর্মঘট এক পর্যায়ে অবস্থান কর্মসূচিতে পরিণত হয়। নিরস্ত্র শ্রমজীবী মানুষের উপর অস্ত্রধারী পুলিশের হামলার প্রতিবাদে বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষ সোচ্চার হয়ে উঠে। বর্বর পন্থায় সে ধর্মঘট দমন করা হয়, ৩ মে ধর্মঘটি শ্রমিকদের এক প্রতিবাদ সমাবেশে পুলিশের গুলিবর্ষণে ৬ জন শ্রমিক প্রাণ হারায়। এর ফলস্বরূপ পরদিন হে মার্কেটে শ্রমিকরা প্রতিবাদ সমাবেশে মিলিত হলে কারখানার মালিকরা সেখানে বোমা বিস্ফোরণ ঘটায় এবং তাতে ৫ জন শ্রমিকের প্রাণহানি ঘটে। ধর্মঘট সংঘটিত করার দায়ে অগাস্ট স্পাইস নামে এক শ্রমিক নেতাকে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়। ১৮৯০ সালে গ্রেট ব্রিটেনের হাইড পার্কে লাখো শ্রমিকের সমাবেশে মে দিবস পালন করা হয়। এর আগে ১৮৮৯ সালে প্যারিসে ২য় আন্তর্জাতিক সম্মেলনে আন্তর্জাতিকভাবে ১লা মে মহান মে দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় হয়। ধীরে-ধীরে ১লা মে শ্রমজীবী মানুষের প্রতি সংহতির প্রতীক হিসেবে মহান মে দিবস পৃথিবীর দেশে-দেশে যথাযোগ্য মর্যাদা লাভ করে, সেই থেকে মহান মে দিবস পালন করা হচ্ছে।
ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে অগাস্ট স্পাইস বলেছিলেন, ÒThe time will come when our silence will be more powerful than the voices you strangled todayÓ” বৈষম্যের বিরূদ্ধে বিশ্বব্যাপী আন্দোলনের পটভূমিতে মে দিবস বারবার সে কথাই মনে করিয়ে দেয়।
আমাদের দেশের সকল মজদুর মানুষের জীবন সংগ্রামের অব্যক্ত কাহিনী আর নয় এবারের মহান মে দিবস হয়ে উঠুক মজদুর মেহনতি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার দিন।
লাল সালাম সকল শ্রমজীবী মানুষের প্রতি।
তথ্যসূত্র:
১. আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (International Labour Organisation,ILO) প্রতিষ্ঠার ঘোষনা পত্র ও নিউজলেটার আইএলও-২০১৯।
২. কার্ল মার্কস ও ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস কমিউনিস্ট ঘোষণাপত্র ১৮৪৮।
৩. বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, বাংলাদেশের জাতীয় কবি।
৪. কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়, পশ্চিম বাংলা।
৫. শ্রম ও শিল্প আইন, অধ্যাপক এ এ খান।
৬. বাংলাদেশ শ্রমবিধিমালা-২০১৫ ও বাংলাদেশ শ্রম কল্যাণ ফাউন্ডেশন আইন-২০১০।
৭. মে‘দিবস-বাংলাপিডিয়া।
৮. বাংলাদেশ গেজেট- ১৫, ২০১৫।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন